শনিবার, ১১ জুলাই, ২০২০

আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার

আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাট বাধা সমুদ্র সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই।  (ফ্রাঞ্জ কাফকা)। সেই বরফ ভাঙ্গার জন্য পলান সরকার  তার জীবনের ৩০ বছরের ও বেশি সময় ব্যয় করেছেন। আলোর ফেরিওয়ালা পলান সরকার জ্ঞানের আলোকবর্তিকা হাতে  রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামের মানুষকে আলোকিত করেছেন।



পলান সরকার ১৯২১ সালে নাটোর জেলার বাগাতিপাড়া উপজেলার নূরপুর মালঞ্চি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।মাত্র পাঁচ মাস বয়সে তার বাবা হায়াত উল্লাহ সরকার মৃত্যুবরণ করেন। এরপর চতুর্থ শ্রেণিতে পড়া শেষে মায়ের সঙ্গে নানার বাড়ি রাজশাহী জেলার বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামে চলে যান তিনি।আর্থিক অনটনের কারণে ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করে পলান সরকার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার ইতি টানেন। কিন্তু বই পড়ার অভ্যাস থেকে যায় আজীবন।




জীবনের এক পর্যায়ে জীবিকার জন্য যাত্রাদলে যোগ দিয়েছিলেন।সেখানে তিনি ভাঁড়ের চরিত্রে অভিনয় করতেন।অভিনয়ের ফাঁকফাঁকে যাত্রার পাণ্ডুলিপি হাতে লিখে কপি করতে হতো।কারণ তিনিই ছিলেন সেই দলের একমাত্র লেখাপড়া জানা ব্যক্তী। অন্যদিকে মঞ্চের পেছন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সংলাপ বলে দিতেন।

প্রচার বিমুখ এই মানুষটি ১৯৬৫ সালে হারুন অর রসিদ শাহ দ্বিমুখী উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ৫২ শতাংশ জমি দান করার পর স্থানীয়দের অনুরোধেই চেয়ারম্যান পদে আসীন হন।সেই স্কুলে প্রতিবছর যারা মেধাতালিকায় প্রথম দশটি স্থান অর্জন করত তাদের বই উপহার দিতেন পলান সরকার। এরপর অন্যান্য শিক্ষার্থীরাও তার কাছে বইয়ের আবদার করলে তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে তিনি তাদেরও বই দিবেন তবে তা ফেরত দিতে হবে। 


এভাবেই শুরু হয় বই পড়া আন্দোলনের ভিত। ১৯৯২ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ায় পলান সরকারকে হাঁটার অভ্যাস করতে হয়। তখনই তার মাথায় এক অভিনব চিন্তা আসে।তিনি স্কুলকেন্দ্রিক বই বিতরণের প্রথা ভেঙে বাড়িতে বাড়িতে বই পৌঁছে দেয়া এবং ফেরত নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কোনো বিয়ের অনুষ্ঠানে অন্যান্য জিনিসের পাশাপাশি তিনি বইও উপহার দেন।

এছাড়া যারা তার বাউসা বাজারে থাকা চালকলে দেনা পরিশোধ করে তাদেরও তিনি বই উপহার দেন। তার কর্মকাণ্ড সমাজে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে।
এলাকার চায়ের দোকানি পর্যন্ত হয়ে ওঠে বইপাগল, প্রতি বিকালে তার দোকানে বসে বই পড়ার আসর।  



বাউসা গ্রামের খুব ভোরে যারা মাঠে যেত, তারা সবার আগে পলান সরকারকেই দেখতে পেত। গ্রামের লোকজন খুব ভোরেই তার কড়া নাড়ার শব্দ শুনতে পায়। আর দরজা খুললেই দেখা যেত হাসি মুখে পলান সরকার দাঁড়িয়ে।
প্রতিদিন খুব ভোরে উঠেই বইয়ের ঝোলা কাঁধে পলান বেরিয়ে যেতেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে দূর দুরান্তের গ্রামে যেতেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কড়া নেড়ে বই দিতেন এবং তা আবার সপ্তাহখানেক বাদে ফেরত নিতেন।

কোনো বাড়িতে গেলে তাকে খুব আপনজনের মত সমাদর করা হত।এভাবে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার প্রায় ২০টি গ্রামে হাজারো মানুষকে তিনি যে আলোয় আলোকিত করেছেন তা এ দেশে খুব বিরল। সাধারণ গৃহিণী থেকে শুরু করে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রীদের নিকট হয়ে উঠলেন বইওয়ালা দুলাভাই। । গ্রামের পথে ঘুরতে ঘুরতে নিজেই হয়ে উঠলেন এক ভ্রাম্যমাণ পাঠাগার। তার এই বই পড়ার আন্দোলন উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের সেই সুবিধাবঞ্চিত গ্রামগুলোতে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা ফেলে। আবদুর রহিম নামক এক মুদি দোকানদার তার নিয়মিত পাঠক।






৫৫ বছর বয়সী এই মুদি দোকানদার প্রচুর বই পড়তেন, আবার প্রতিদিন বিকেলে পাঠক সমাবেশ করতেন। পলান সরকারের এই উদ্যোগ এক মাদকাসক্তকেও দিয়েছিল নতুন জীবন।
কম। ২০০৯ সালে রাজশাহী জেলা পরিষদ তার বাড়ির আঙিনায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করে।




সম্মাননা : প্রথমে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার কয়েকটি গ্রামের মানুষই জানত পলান সরকারের এই শিক্ষা আন্দোলনের গল্প। ২০০৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর বিটিভি চ্যানেলের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ইত্যাদি তাকে আলোকিত মানুষ হিসেবে তুলে ধরা হয়। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে পলান সরকারের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

তিনি ২০১১ সালে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মান একুশে পদক লাভ করেন। ২০১৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম ডে’ উপলক্ষে সারা বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার দৈনিকে তার ওপর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে বিটিভির জন্য গোলাম সারোয়ার দোদুল নির্মাণ করেন ঈদের নাটক 'অবদান'। বিনামূল্যে বই বিতরণ করে সবার মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ সৃষ্টির করার জন্য ইউনিলিভার বাংলাদেশ পলান সরকারকে 'সাদা মনের মানুষ' খেতাবে ভূষিত করে। 

অবশেষে রাজশাহীর বাঘা উপজেলার বাউসা গ্রামের বাড়িতে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে ১ মার্চ শুক্রবার দুপুরে পরপারে পাড়ি জমান এই আলোকিত মানুষ পলান সরকার।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন